এড. রাসেল রাফি:
গণতন্ত্রের মৌলিক দর্শন হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহির নিশ্চয়তা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা সমষ্টিগতভাবে সংসদের নিকট দায়বদ্ধ। একই সঙ্গে সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতা জনগণের”। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, জনগণের ইচ্ছাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্দেশনা হওয়া উচিত।
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একজন ব্যক্তি যদি একযোগে হন সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও সংসদীয় দলের নেতা-তবে সেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে একটি মাত্র ব্যক্তির ওপর। এর ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত ও রাষ্ট্রীয় নীতি প্রায় অভিন্ন হয়ে যায়, যা গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের পরিপন্থী। সংসদ তখন কার্যত সরকারের অনুমোদন কেন্দ্র হিসেবে রূপ নেয়, যেখানে বিরোধী মত ও প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গণতন্ত্র তখন কেবল আকারে বেঁচে থাকে, কার্যত হারিয়ে ফেলে প্রাণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত এক যুগে আমাদের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে-যার ফলশ্রুতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গঠনমূলক বিতর্ক ও বিকল্প চিন্তার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারতসহ বহু সংসদীয় গণতন্ত্রে দলপ্রধান ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব আলাদা রেখে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়। ভারতের উদাহরণে দেখা যায়-মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে ছিলেন সনিয়া গান্ধী। এতে দলীয় আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নীতির মাঝে একধরনের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় ছিল।
এখন সময় এসেছে বাংলাদেশেও সেই অনুশীলন শুরু করার।
একক নেতৃত্ব নয়, প্রতিষ্ঠানের শক্তিতে গণতন্ত্রের বিকাশ হোক-এই হোক আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারের মূলমন্ত্র। দল, সরকার ও সংসদের নেতৃত্ব পৃথক থাকলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে এমন বিধান সংযোজন করা যেতে পারে, যাতে একই ব্যক্তি দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান না হন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পদে থেকেও দলীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকার প্রশ্নটি নতুনভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে।
গণতন্ত্রকে ব্যক্তিনির্ভরতা থেকে প্রতিষ্ঠাননির্ভরতার পথে ফিরিয়ে আনা-এটাই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের রাজনৈতিক সংস্কার যাত্রার প্রথম ধাপ।
এড. রাসেল আহমেদ রাফি
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও সমাজসংগঠক